৩৩ দিনের বন্দিদশা, প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি—কিন্তু ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদের স্থিরতা ও সাহসিক নেতৃত্বই ফিরিয়ে আনল ২৩ নাবিকের জীবনের আলো।
২০২৪ সালের ১২ মার্চ, বাংলাদেশের পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের পথে যাত্রা করছিল। জাহাজটি ৫৫,০০০ টন কয়লা নিয়ে সাগরে ভাসমান অবস্থায় ছিল, ঠিক তখনই সোমালিয়ার উপকূল থেকে মাত্র ৭২ নটিক্যাল মাইল দূরে আক্রমণ করে বসে সশস্ত্র জলদস্যুরা। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি ঘোরতর হয়ে ওঠে—জাহাজের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জলদস্যুদের হাতে, এবং ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুর রশিদসহ ২৩ জন নাবিক জিম্মি হয়ে পড়েন।
জিম্মি থাকার পুরো ৩৩ দিন ছিল আতঙ্ক, চাপ এবং অনিশ্চয়তার এক কঠিন পরীক্ষা। প্রতিদিন ছিল নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন হুমকি। জলদস্যুরা প্রথমদিকে বন্দুকের মুখে সবাইকে কনটেইনার ডেকে শুইয়ে রাখে। সেখানে কোনো শৌচাগার ছিল না, খাবার ও পানির ছিল চরম সংকট।
ক্যাপ্টেন রশিদ পরবর্তীতে বলেন,
“জলদস্যুরা আমাদের মাথার ওপর বন্দুক ঠেকিয়ে বলত, ‘মরে যেতে চাও?’—সেই সময়ও আমি শুধু ভেবেছি, কীভাবে আমার নাবিকদের মনোবল ধরে রাখা যায়।”
তিনি তার ঠাণ্ডা মাথা ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ধীরে ধীরে জলদস্যুদের বিশ্বাস অর্জন করেন। প্রথম কয়েকদিনে জল ও খাবার বণ্টনের দায়িত্ব নিজে নিয়ে জাহাজের সবাইকে পর্যাপ্ত রেশনিং করেন। কৌশলে জলদস্যুদের বোঝান যে, যদি নাবিকরা অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে জাহাজ চালানোই সম্ভব হবে না। এই যুক্তি কাজে দেয়।
পরবর্তী দিনগুলোতে তিনি জলদস্যুদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নাবিকদের কেবিনে ফিরে যাওয়ার অনুমতি আদায় করেন। ধীরে ধীরে কিছু মানবিক সুযোগ-সুবিধা আদায় সম্ভব হয়। প্রতিটি সিদ্ধান্তে ক্যাপ্টেন রশিদের ঠান্ডা মাথা ও সাহসিকতা ছিল স্পষ্ট।
“আমার একটাই লক্ষ্য ছিল—প্রত্যেক নাবিককে জীবিত ও নিরাপদে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া,” বলেন তিনি।
৩৩ দিন পর, ১৪ এপ্রিল, পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মুক্তিপণের বিনিময়ে জলদস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে দেয়। এমভি আবদুল্লাহ এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্দরে পৌঁছায় এবং পরবর্তীতে সবাই নিরাপদে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
ক্যাপ্টেন রশিদের সাহসিকতা, নেতৃত্ব এবং মানবিকতা শুধু তার সহকর্মীদের জীবন রক্ষা করেনি, বরং পুরো জাতিকে গর্বিত করেছে। ভবিষ্যতের নাবিকদের কাছে তার এই অভিজ্ঞতা এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ—নামটি এখন শুধুই একজন জাহাজ মাস্টারের পরিচয় নয়, বরং এক সাহসী নেতৃত্বের প্রতীক, যিনি জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও নিজের কাঁধে ২৩টি প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন দেশের মাটিতে।
বিডিবার্তা/রাহাঅ